শিশু পরিচর্যার বিষয়টি প্রতিটি মায়ের তার
জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে চিহ্নিত হয়ে থাকে । কারণ প্রত্যেক মা – ই
চান একান্তভাবে তার শিশুকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে ।আর সদ্যজাত শিশুর
বেলায় তো আরও বাড়তি যত্ন নিবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।
সদ্যজাত শিশু বলতে শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে চার সপ্তাহ বা এক মাস
বয়সের শিশুকেই সাধারণতঃ বুঝায় । আর সদ্যজাত শিশুর যত্ন বলতে শিশুর
ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশুর নাড়ী কাটার বিষয়টি খুব গুরুত্বসহকারে নেওয়া
উচিত ।হাসপাতালে শিশু ভুমিষ্ঠ হলে সাধারণতঃ অসুবিধা হবার কথা নয় । কারণ
সেখানে শিশুর নাড়ী কাটার জন্য ছুরি ,কাঁচি ,ফোরসেপ ,ইত্যাদি পানিতে
ফুটিয়ে জীবানুমুক্ত করবার পর ব্যবহার করা হয় । তবে ,গ্রামে ,গন্জে
অশিক্ষিত দাই এর কবলে পড়ে সঠিকভাবে জীবানুমুক্ত না করে,ছুরি বা ব্লেড
দিয়ে শিশুর নাড়ী কাটলে অথবা নাভীর গোড়ায় অপরিষ্কার কাপড় বা অন্যকিছু
ব্যবহার করলে শিশুর ধনুষ্টংকার রোগের সম্ভাবনা থাকে । তাই যেখানেই শিশু
ভুমিষ্ঠ হোক না কেন নাড়ী কাটবার জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি ব্লেড সূতা ইত্যাদি
পরিষ্কার পানিতে আধঘন্টা ফুটিয়ে জীবানুমুক্ত করে তারপর ব্যবহার করা উচিত ।
এরপর শিশুকে ত্বড়িৎ গতিতে তার শরীরটা মুছে নিয়ে নরম ও মোটা কাপড় দিয়ে
ঢেকে রাখতে হবে এবং পরিষ্কার কাপড় অথবা তুলা দিয়ে শিশুর নাকের ও মুখের
ভিতর থেকে পানি মুছে ফেলতে হবে ।
শিশু মাতৃগর্ভে একরকম পানির ভিতর থাকে ,যাকে Amniotic fluid বলে । তাই
শিশু ভুমিষ্ঠ হবার পর ঐ পানি নাক ও মুখ দিয়ে ফুসফুস ও পেটের ভিতর চলে
যাবার সম্ভাবনা থাকে । আর যদি ফুসফুসে বেশী পানি চলে যায় ,তবে শিশু শ্বাস
নিতে পারেনা ।তাই শিশুর শরীর নীল হয়ে যেতে থাকে এবং অনেক সময় শিশুর
মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে । এরপর শিশুর নাড়ী কটবার পর মাথা নিচের দিকে করে
,পা দুটি উপর দিকে তুলে ধরে পিঠে এবং পায়ের পাতায় আস্তে আস্তে চাপড় দিতে
হয়।এতে করে শিশুর নাক ও মুখ দিয়ে পানি পড়ে যেতে সাহায্য হয় এবং শিশু
হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে অর্থাৎ সে শ্বাস নিতে শুরু করে এবং পৃথিবীকে তার
আগমনবার্তা জানিয়ে দেয় । মায়ের পেটের ভেতর থেকে বাইরের পৃথিবীর
সংস্পর্শে শিশু একটি সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশের মধ্যে এসে পড়ে । সুতরাং
প্রথমেই বাইরের পরিবেশের কথা ভাবতে হবে ,যেমন যদি শীতকাল হয় তবে যথাসম্ভব
গরম কাপড় দিয়ে শিশুকে জড়িয়ে রাখতে হবে যেন ঠান্ডা না লাগে ।তাই বলে
দিনের বেলায় ঘরবাড়ী বন্ধ রেখে অন্ধকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা
ঠিক নয় ।
এরপর বলা যায়,শিশুর পোশাকের কথা ।সদ্যজাত শিশুর জামাকাপড় অবশ্যই
সূতিকাপড় এবং সেইসাথে যথাসম্ভব নরম ও পাতলা হওয়া উচিত । বিশেষ করে যে
কাপড়টি শিশুর শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে ।এর উপর প্রয়োজন বোধে শীতকালে গরম
কাপড় পরাতে হবে ।এবং জামায় বোতাম বা এই জাতীয় শক্ত জিনিষ লাগান উচিত নয়
,কারণ এতে করে শিশুর শরীরে আঘাত লাগতে পারে । এছাড়া নতুন জামা না
পরিয়ে,সেগুলো ধোয়ার পর নরম করে তবে পরতে দেওয়া ঊচিৎ ।আর synthetic
কাপড়ের তৈরী জামা পরতে দেওয়া ঠিকক নয় ।কারণ সদ্যজাত শিশুর শরীরের চামড়া
খুব স্পর্শকাতর হয়ে থাকে।আর তাই synthetic সংস্পর্শে এলে শিশুর শরীরের
চামড়ার ক্ষতি হতে পারে ।এবং নানারকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে । তবে সুতি
কাপড় পরলেও এমনিতেই অনেকসময় শিশু জন্মাবার কয়েকদিন পর শরীরে লাল লাল
একরকম দানার মতন দেখা দিয়ে থাকে । কয়েকদিন পর এমনিতেই সাধারণতঃ সেরে যায়
। তবে ভাল হতে যদি দেরী হয় তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত ।
এরপর আসা যাক – ,সদ্যজাত শিশুর খাবার ব্যাপারে ।একথা আজ প্রায় সকলেরই
জানা হয়ে গেছে যে ,মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট খাবার ।এর
কোনবিকল্প নেই। শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম খাবারই হতে হবে মায়ের বুকের
দুধ । এতে করে মায়ের ও শিশুর মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে । এছাড়া
মায়ের বুকের প্রথম দুধ যেটাকে শাল দুধ বলে ,এবংএই দুধ একটু ঘন এবং
কিছুটাহলুদ বর্ণের হয় । অনেকে এটা খারাপ দুধ ভেবে ফেলে দেয় । অবশ্য
বর্তমানে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে অনেকটাই ।এই দুধের ভিতরই রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা অনেক গুন বেশী থাকে । অতএব কোন অবস্থাতেই এই শাল দুধ ফেলে দেওয়া
উচিত নয় । এছাড়া শিশুকে খাওয়াবারও একটা নিয়ম আছে । শিশুকে শুইয়ে অথব
কোলে নিয়ে দুধ খায়াবার পর কাত করে কিছুক্ষণ মায়ের বুকে চেপে রাখলে
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে শিশুটি ঢেঁকুর তুলেছে অর্থাৎ পেটেরগ্যাস
বেরিয়ে গেছে । এরপরই শিশু বেশ আরাম বোধ করে । সদ্যজাত শিশুকে সাধারণতঃ দুই
থেকে তিন ঘন্টা অন্তর খেতে দেওয়া উচিত । এবং দুধ খাবার মঝখানে ফুটান পানি
ঠান্ডা করে খাওয়াতে হবে । তাহলে শিশুর পেটে গ্যাস হবেনা। পায়খানা ভাল
হবে এবং শিশু পেটের ব্যাথায় কষ্ট পাবেনা ।অনেক সময় মায়েরা বুঝতে পারেননা
,শিশু কেন কাঁদছে । সাধারণতঃ পেটে গ্যাস হবার দরুণ পেটে ব্যাথা হয় এবং
শিশু কান্নাকাটি করে ।এমনটি হলে শিশুকে বেশী বেশী ফুটান পানি পান করান উচিত
।
অনেক সময় মায়ের বুকেরদুধ অপর্যাপ্ত মনে হওয়ায় গুড়ো দুধ বোতলে ভরে
খাওয়াবার ব্যাবস্থা করেন ।এটা মোটেই ঠিক ক নয় । শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর
মায়ের বুকে দুধ আসা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম । সুতরাং মায়ের বুকের দুধ কম
বেশী হতেই পারে । কিন্তু তাবলে মা কে হাল ছেড়ে দিলে চলবেনা ।মা কেই চেষ্টা
করতে হবে বুকের দুধের পরিমান বাড়াবার জন্য । কারণ শিশুর জন্য বুকের দুধের
বিকল্প কিছু নেই । শিশুকে ঘন ঘন স্তন চুষতে দিলে মায়ের বুকে যথেষ্ট দুধ
তৈরী হয় । এজন্য দিনে রাতে যখন শিশু যখন চাইবে তখনই তাকে বুকের দুধ
খাওয়াতে হবে এবং শিশুকে অন্য খাবার দেওয়া যাবেনা । যে মা বাচ্চাকে বুকের
দুধ খাওয়ান, তার প্রচুর খাবার ও বিশ্রাম দরকার । তাহলে মায়ের শরীরও ভাল
থাকবে এবংবুকের দুধও বাড়বে । এজন্যে মায়ের খাবারে পর্যাপ্ত পরিমানে দুধ
থাকতে হবে । সাথে ডিম মাছ,মাংস , সবজি ইত্যাদি থাকতে হবে । তবে যদি কোন
কারণে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান সম্ভব না ই হয় ,তবে ডাক্তারের পরামর্শ
নিতে হবে । ডাক্তার যদি গরুর দুধ বা গুড়ো দুধ খওয়াতে বলেন,তবে দুধ
খাওয়ার বোতল বা বাটি ভাল করে পানিতে ফুটিয়ে ,জীবানুমুক্ত করে তবে
খাওয়াতে হবে । তবে গুড়ো দুধ পরিহার করাই ভাল । কারণ এই দুধ ভেজাল হওয়ার
সম্ভাবনাই বেশী । এছাড়া মায়ের বুকের দুধের মত সহজপাচ্য নয় এবং
শিশুরউপযোগী প্রয়োজনীয় উপাদানও এতে থাকেনা ।
সদ্যজাত শিশুর থাকবার থাকবার ঘরের বিষয়েও ভাববার প্রয়োজন আছে । শিশুকে
সব সময় ঘরের মধ্যে বন্দ করে রাখাও ঠিকক নয় এবং যে ঘরে প্রচুর আলোবাতাস
খেলা করে এবং শিশু হাত পা ছুড়ে খেলা করতে পারে এমন ঘরে তাকে রাখা উচিত ।
শীতকাল হলে যাতে করে শিশুর ঠান্ডা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে । আর
যদি খুব গরম পড়ে তবে শিশুকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে,গায়ের ঘাম
মুছে,পাউডার লাগিয়ে পাতলা সুতি কাপড় পরিয়ে রাখা উচিত। এতে করে শিশু বেশ
আরাম বোধ করে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শিশুকে সাবধানতার সাথে গোসল করানো । কারণ
সাবধান হয়ে গোসল না করালে কানে পানি যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর কানে পানি
গেলেinfection হয়ে কানপাকা রোগ হয়ে যেতে পারে । এরপর যদি সময়মত চিকিৎসা
না করা হয় তবে কানের পর্দা ফুটো হয়ে গিয়ে শিশু চিরকালের জন্য বধির হয়ে
যায় । অর্থাৎ কানে কম শোনে । অতি সামান্য কারণে অর্থাৎ গোসল করার ত্রুটির
কারণে শিশুর জীবনের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে ।
সবশেষে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে,বাড়ীতে যদি কোন ছোঁয়াচে অসুখ কারও
হয়ে থাকে যেমন হাম, চিকেন পক্স,হেপাটাইটিস,ইত্যাদি,তাহলে রোগী যে ঘরে থাকে
সেঘর থেকে শিশুকে দূরের একটি ঘরে রাখতে হবে এবং কোন ক্রমেই যেন শিশু তার
সংস্পর্শে না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে । আর সেইসাথে আর একটি কথাও মনে
রাখতে হবে যে শিশুরজন্মের পর থেকে ছয় সপ্তাহ বয়সের সময়ের মধ্যে শিশুকে
ডিপথেরিয়া,ধনুষ্টংকার ,পোলিও,হুপিংকাশী ও যক্ষা রোগের টিকা দিয়ে দিতে হবে
। এইভাবে সঠিক সময়ে টিকাা দিয়ে দিলে শিশুর ঐসব রোগের ভয় থাকেনা । আর
যেহেতু সদ্যজাত শিশুর, বড়দের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম থাকে ,সে
কারণে শিশু কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে অতিসত্বর চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার প্রয়োজন ।
এভাবে সদ্যজাত শিশুকে যত্ন,পরিচর্যা আর রোগের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখলে সে শিশু সুস্থ ও সবল হয়ে বেড়ে ওঠে ।