সদ্যোজাতের যত্ন খুব সহজ কথা নয়। বিশেষ করে যিনি প্রথম বার মা হচ্ছেন, তাঁর কাছে। কিছু সতর্কতা আর সামান্য ধৈর্য কাজটা অনেক সহজ করে দেয়। চিকিৎসকদের মতে, মায়ের শরীর থেকে আলাদা হওয়ার পরে শিশুর তাপমাত্রার বিষয়টি আগে খেয়াল রাখা উচিত। সে যাতে ঠিক মতো অক্সিজ়েন পায়, তা দেখতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালের কর্মীরাই অবশ্য এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
ব্রেস্ট মফিডিং
শিশুর জন্মের পরে যত দ্রুত সম্ভব তাকে মায়ের কাছে দিতে হবে। এতে মা আর সন্তানের যোগাযোগ তৈরি হয়। মায়ের বুকের মধ্যে থাকলে সেই তাপমাত্রা সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। মায়ের ব্রেস্ট মিল্ক সিক্রেশনের জন্যও তা জরুরি। শিশু চিকিৎসক ড. অপূর্ব ঘোষ জোর দিলেন, মায়ের ব্রেস্ট থেকে প্রথম যে হলুদ দুধ (কোলোস্ট্রাম) বেরোয়, তা যেন শিশুকে অবশ্যই খাওয়ানো হয়। কোলোস্ট্রামে প্রচুর অ্যান্টিবডি রয়েছে। যা বাচ্চার ইমিউনিটির সহায়ক। অনেক সময়ে মায়ের দুধ আসতে দেরি হয়। মিল্ক সিক্রেশনের জন্যও বাচ্চার সাকিং জরুরি।
খেয়াল রাখুন
•
আবহাওয়া বুঝে পোশাক পরাবেন। হালকা সুতির পোশাক পরান। ইলাস্টিক দেওয়া কিছু
ব্যবহার না করাই ভাল। শীতকালে অতিরিক্ত পোশাক ভুলেও পরাবেন না। এতে শিশুর
শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে জ্বর এসে যেতে পারে
• ঘণ্টা তিনেকের বেশি ডায়পার পরিয়ে রাখবেন না
• শিশুর নাক-কান পরিষ্কার করতে যাবেন না। সাবধানে নখ কাটবেন
• সদ্যোজাত শিশুর ক্ষেত্রে তো নয়ই, অন্তত বাচ্চার আট মাস বয়স অবধি বেবি ক্যারিয়ার ব্যবহার করবেন না। এতে মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে
পরিচ্ছন্নতা
আপনার ছোট্ট সোনাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকেই শুরু হবে আসল কর্মকাণ্ড। মায়ের শরীরে থাকার সময়ে শিশু ঘেরাটোপের মধ্যে থাকে। তাই বাড়িতে যতটা সম্ভব হাইজিন মেনে চলতে হবে। শিশুকে বেশি লোকজনের কোলে দেবেন না। তাকে নেওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুয়ে নেবেন। বাচ্চার পোশাক, বিছানা যাবতীয় জিনিস পরিচ্ছন্ন হওয়া জরুরি।
আম্বিলিক্যাল কর্ড কাটার পরে নাভির জায়গাটি যেন শুকনো থাকে দেখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে নাভিতে ড্রপ বা পাউডার দিতে পারেন, যাতে জায়গাটি শুকিয়ে যায়। অনেক অভিভাবকই বাচ্চাকে কতক্ষণ ডায়পার পরাবেন, কখন বদলাবেন— এ নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। চিকিৎসকেরা কিন্তু ঘরোয়া ন্যাপির পরামর্শ দিচ্ছেন। ডায়পার থেকে র্যাশও হতে পারে। ডাক্তার অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘আমি ডায়পারের পক্ষপাতী নই। তাতে বিছানা বাঁচতে পারে, বাচ্চা নয়। ডায়পার পরে সে তো ইউরিন, স্টুলের মধ্যেই রইল। শিশুদের ডায়পার ডার্মেটাইটিস সাধারণ সমস্যা।’’
সাবধানে স্নান
সদ্যোজাতকে স্নান নয়, স্পাঞ্জিংয়ের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। বাইরের তাপমাত্রা বুঝে ঠান্ডা-গরম জল মিশিয়ে শিশুকে স্পাঞ্জ করান। সদ্য জন্মানো শিশুর গায়ে সাদা আস্তরণ থাকে। তা সময়ের সঙ্গে এমনিই উঠে যাবে। জোর করে তোলার দরকার নেই। রোজ একটি নির্দিষ্ট সময়েই শিশুকে স্নান করাবেন। স্নানের সময়ে সাবান দিতে বাধা নেই। তবে অনেক চিকিৎসকই প্রথম এক মাস শিশুকে জল দিয়েই স্পাঞ্জ করাতে বলেন।
একদম ছোট শিশুকে তেল মাখানো নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই শিশুর হাড় মজবুত করার জন্য তেল মাখিয়ে রোদে রাখতে বলেন। ড. ঘোষের কথায়, ‘‘তেল মাখালে আলাদা করে কিছু লাভ হয় না। টাচ থেরাপি কাজে দেয়, এটুকুই।’’ অধিকাংশ শিশু চিকিৎসকই প্রথম তিন মাস শিশুদের কিছু মাখাতে নিষেধ করেন। মাসাজ করারও প্রয়োজন নেই। কারণ এই সময়ে বাচ্চাদের হাড় খুব নরম থাকে। হাতের আলতো চাপেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিছু অসুখ এবং ভ্যাকসিন
সদ্যোজাতদের জন্ডিস হওয়ার প্রবণতা থাকে। শিশু ও মায়ের ব্লাড গ্রুপের সঙ্গে এই জন্ডিসের সম্পর্ক রয়েছে। হাসপাতালেই শিশুর বিলিরুবিনের মাত্রা দেখে নেওয়া হয়। কিন্তু বাড়িতে আসার পরেও জন্ডিসের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। সে রকম কিছু বুঝলে অবিলম্বে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
বাচ্চার জন্মের চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই থাইরয়েড চেক করিয়ে নিতে হবে। থাইরয়েড ধরা পড়তে দেরি হলে, বাচ্চার ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। জন্মের পরে যত দ্রুত সম্ভব বিসিজি, পোলিও এবং হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন শিশুকে দিতে হবে। এ বিষয়গুলি বাবা-মায়েরও খেয়াল রাখা জরুরি।
পারলে শিশুর চোখ, কান, নাক ঠিক আছে কি না, সেই পরীক্ষাও করিয়ে নিতে পারেন। অনেক সেন্টারে মেটাবলিক টেস্টও করিয়ে নেওয়া যায়। তবে এগুলো সবটাই নির্ভর করে অভিভাবকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপরে।
শিশুদের পেটে ব্যথা হওয়াও আশ্চর্যের নয়। এতে ঘাবড়াবেন না। ডাক্তারের নির্দেশ মতো পেটে ব্যথার ওষুধ দিয়ে দেবেন। সর্দি হলে এত ছোট বাচ্চাকে কোনও ওষুধ দেওয়া উচিত নয়। নাক বন্ধ হলে বড় জোর স্যালাইন ড্রপ দিতে পারেন।
কিছু মিথ এবং বাস্তব
• শিশুকে রোদে রাখা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। রোদ থেকে যে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, তা হাড়ের জন্য ভাল। অবশ্য বর্তমানে দূষণ যে হারে বেড়েছে, তাতে সদ্যোজাতকে রোদের মধ্যে রেখে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই চিকিৎসকেরা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ভিটামিন ডি প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
• যাঁরা প্রথম বার মা হচ্ছেন, তাঁরা বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে একটু সমস্যায় পড়েন। কখনওই বাচ্চাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম পাড়াবেন না। খাওয়ানোর পরে বাচ্চাকে ডান-বাঁ যে কোনও দিকেই শোয়াতে পারেন। অনেক শিশুর দুধ তোলার প্রবণতা থাকে। সে ক্ষেত্রে বালিশে একটু উঁচু করে শোয়ানো যেতে পারে।
• শিশুদের সর্ষে-বালিশে শোয়ানোর প্রথা রয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আপনার উপর নির্ভর করছে। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। শুধু খেয়াল রাখবেন, শোয়ানোর সময়ে বাচ্চার মাথা যেন একটু উঁচুতে থাকে। আর মাঝেমধ্যে অবস্থান বদলে দেবেন।
• সদ্যোজাতদের শরীরে অতিরিক্ত জলের প্রয়োজন নেই। শিশু মায়ের দুধ খেলে তো বটেই, যারা বাইরের দুধ খায়, তাদেরও দরকার পড়ে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন